দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক এক হিসাব অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে ছয়টি জেলায় ২২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে ৯ জনের মৃত্যুর খবর বলা হলেও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে যে সব মৃত্যু ঘূর্ণিঝড়ের সাথে সম্পর্কিত নয়, সরকারি তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের সরাসরি প্রভাবে মৃতের সংখ্যা ৪ । ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষির কোন ক্ষতি হয়নি বলা হলেও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে? শাহনাজ পারভীনের প্রতিবেদন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার নিয়ামতপুরের বাসিন্দা শেফালী দাস হাওড়ে তাদের ছয় একর জমিতে বিরি ধান লাগিয়েছিলেন। বলছিলেন সেগুলোর অনেকটাই ডুবে রয়েছে পানির নীচে।
পানি কাল রাতে ঢুকেছে হাওড়ে। ধান কাটার দিকে চলে আসলেও কাটতে পারছি না কারণ ধান সব তলিয়ে গেছে। এখন যেগুলো আছে সেগুলো আনতে পারবো কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আল্লাহ যদি আমাদের বাচায় তবেই বাচবো, নাহলে বাঁচবার উপায় নাই।
যতটুকু বেঁচে আছে সেটুকুও ঘরে তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন তিনি। কারন সীমান্তের ওপারে এখনও বৃষ্টি ঝড়ছে। ধান তোলার দিন প্রায় ঘনিয়ে এসেছিল। ঠিক এমন সময় এই ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে বেশ কিছু এলাকার ফসলী জমি। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ববিতা রানী মণ্ডল আড়াই বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। এখন আশঙ্কা করছেন ঐ অঞ্চলের নোনা পানি তার ফসলের কতটা ক্ষতি করবে।
আমাদের সুন্দরবন লবনাক্ত তো, তাই ধান একবার জলে ডুবে গেলে সেগুলো তুলতে গেলে লাল হয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখায়। তখন সেগুলো খেতে গেলে সুস্বাদু মনে হয়না।
ববিতা রানী বলছেন এই ধান পরবর্তীতে তিনি বাজারজাত করতে পারবেন কিনা সেটিই তার বড় শঙ্কা।
ভয় পাচ্ছি যে ওই ধানগুলো বাজারজাত করতে গেলে লোকে নিতে চাইবে না, ব্যপারীরা নিতে চাইবে না, নিজেরা খেতে গেলেও সমস্যা। যে ভয়টা আমাদের ছিলো না সেটা এই দূর্যোগের কারনে হয়ে গেলো। মাথার উপর এমনিতেই একটা চাপ আছেই। এমনিতেই ধানের বাজারে দাম কম। তারপরেও আমরা এই ধান লাগিয়েছি দুটো পয়সা পাওয়ার আশায়। ধানের বীজ, সার এসবের জন্য একেক বিঘায় ১২ হাজার করে টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন তো সেই টাকাই আমরা তুলতে পারছি না।
প্রাথমিক এক হিসেবের পর দূর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় বলছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, ভোলা ও নোয়াখালী জেলাতেই সবচাইতে বেশী ক্ষতি হয়েছে। মূলত বাতাসের গতির কারনেই বেশকিছু ঘর ও গাছ পরে গেছে। প্রাথমিকভাবে বাইশ শত ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের হিসেব পাওয়া গেছে। এবার কৃষির খুব বেশি ক্ষতি হবেনা বলে সরকারী দপ্তরগুলো মনে করছে। তবে কোস্ট ট্রাস্টের একজন আঞ্চলিক দলনেতা মোসাঃ রাশিদা বেগম বলছেন এসব ঘূর্ণিঝড় একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রেখে যায়। দরিদ্র মানুষ তাদের ভরসার জায়গা ঘর-বাড়ি, গাছ ও গবাদিপশু হারিয়ে ঋণের বোঝায় আক্রান্ত হয়ে পরে।
রাশিদা বেগম বলছেন এই ক্ষতি পোষন তাদের পক্ষে আসলে সম্ভব না, স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য তারা স্থানীয়ভাবে এনজিও অথবা সরকারের বিভিন্ন সেক্টর থেকে ঋণ নিয়ে তারা সাময়িকভাবে ঘর তোলে অথবা ছোটখাটো ব্যবসা বা কৃষিকাজ করে। কিন্তু দেখা গেছে তারা স্থায়ী কোন সমাধানের অভাবে নিশ্চিতভাবে বাস করতে পারে না। কারণ ঘূর্ণিঝড়ের ফলে তাদের যে ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি মোকাবেলা করে উঠতে না উঠতেই তারা অন্য দূর্যোগের সম্মুখীন হয়। তারা ঋণগ্রস্থ হয়েই যায় এবং দরিদ্র মানুষগুলো দরিদ্রই থেকে যায়।
এসব মানুষেরাই ধীরে ধীরে কাজের খোঁজে চলে আসেন বড় শহরগুলোতে। ঘূর্ণিঝড় ফণীতে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের এবারও তাৎক্ষণিকভাবে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় থেকে খাদ্য সহায়তা, নগদ টাকা ও নতুন ঘর বানাতে টিন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বছর বছর আসা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত এসব মানুষকে যেন ঘরছাড়া হতে না হয় সে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কী ধরনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে, জিজ্ঞেস করেছিলাম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ শাহ কামালের কাছে।
প্রায় ১২ হাজার গৃহ আমরা জুনের মধ্যেই করবো যেটা দূর্যোগ সহনীয়। দূর্যোগ সহনীয় হলো, ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি থাকে ২০০ থেকে ২২০ কিলোমিটার, এই ঘরটা যাতে ঘূর্ণিঝড়ে নষ্ট না হয়, বন্যার সময় যাতে পানি উঠতে না পারে, এই কারনে ১৯৮৮ সালকে আমরা বেইস ইয়ার ধরে তার উপরে দুই ফুট পাকা ভিটে করেছি। উপকরনগুলো ব্যবহার করেছি যাতে অন্ততপক্ষে আগামী পঞ্চাশ বছর কারো আর এই ঘরে হাত দিতে না হয়। উপকরণের উপর আমরা অত্যন্ত জোর দিচ্ছি। অর্থাৎ যেই লোকটি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সে যাতে ঘুরে দাড়াতে পারে, তার যেন আর ঘর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে না হয়। এতে করে আমাদের কাজের পদ্ধতি আরও নিয়মতান্ত্রিক হবে।
তিনি আরও বলছেন, এই বছর পশুসম্পদ একটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। তবে দেশে গবাদিপশুর জন্য আরও আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করা হচ্ছে। বাঁধগুলোকে আরও টেকসই করা হচ্ছে এবং আগামী পাঁচ বছরে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার দূর্যোগ সহনীয় ঘর-বাড়ি তৈরী করা হবে বলে জানান তিনি।
কিন্তু ববিতা রানী বা শেফালী দাস সম্ভবত তাদের এবারের ক্ষতি কীভাবে পোষাবেন আপাতত সেই চিন্তা করছেন।