বিশ্ব মানবিক দিবস-২০২৩, জরুরী পরিস্থিতিতে মানবিক কাজে নিয়োজিত সংগঠনগুলো মানুষের পাশে দাঁড়ায়, স্থানীয় সংগঠন শক্তিশালীকরণ ও কর্মীদের অবদানের স্বীকৃতি চাই

0
2032

কেন বিশ্ব মানবিক দিবস পালন করা হয়?

ইরাকের বাগদাদে আজ থেকে ২০ বছর আগে ১৯ আগস্ট ২০০৩ সালে সন্ত্রাসীদের এক আক্রমণে আমরা মানবিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত জাতিসংঘের ২২ জন সহকর্মীকে হারিয়ে ফেলি। এই ঘটনা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। যেখানে সহায়তা প্রদানকারী বা উদ্ধারকারী কর্মীদের সম্মানের চোঁখে দেখার কথা সেখানে কি করে তারা টার্গেটে পরিণত হলো?

এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দুর্যোগ বা জরুরী পরিস্থিতিতে আক্রান্ত ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে আজ সহায়তা পৌঁছে দিবে কে? কে তাদের সঠিক সময়ে সরিয়ে নেবে? কে আক্রান্ত মানুষগুলোকে নিজের জীবন বাজী রেখে স্বাস্থ্য/ চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে? অনেক মানুষেরই ভিনড়বমত, রাজনৈতিক মত-পার্থক্য, বিশ্বাস, ধর্ম, জাত-পাত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভিন্নতা থাকতে পারে। তারা নিজেদের স্বার্থ পূরণে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঘৃণামিশ্রিত প্রচারাভিযান চালায়, সহিংসতাকে উসকে দেয়। এর ফলে সহায়তা প্রদানকারী ব্যক্তি বা উদ্ধারকারী ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের আক্রমণের শিকার হন। আমাদের প্রশ্ন হলো, ভিন্নমতের মানুষদেরকে সহায়ত প্রদান বা উদ্ধার করতে গেলে কেন মানবিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিরা আক্রমণের শিকার হবেন? এটি একটি ভুল বার্তা। এই সকল বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে মানবিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর প্রতি মানুষের মানুষের শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

মানবিক কর্মীরা রয়েছেন গভীর সংকটে

হিউম্যানিটারিয়ান আউটকামস্ ২০২১ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ৪৬০ জন এইড ওয়ার্কার বা মানবিক সহায়তা প্রদানকারী ব্যক্তি দায়িত্ব পালনকালীন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪০ জন মৃত্যু বরণ করেন, যার মধ্যে ৯৮% হলেন স্থানীয় সংগঠনগুলোর কর্মী এবং বাকী ২% হলেন আন্তর্জাতিক সংগঠনের কর্মী। এই সময়ে ২০৩ জন আহত হন এবং ১১৭ জন কিডন্যাপের শিকার হন। দিন দিন পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করছে এবং এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্থানীয় সংগঠন ও মানবিক কর্মীরা কেন গুরুত্বপুর্ণ?

সারা বিশ্বে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে স্থানীয় সংগঠন ও তাদের কর্মীরা প্রায় সময়ই দুর্যোগ বা জরুরি পরিস্থিতে প্রথম সাড়াদানকারী। যথাযথ ও সঠিক সময়েই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর কারণ হলো তারা একই কমিউনিটি থেকে উদ্ভত এবং কমিউনিটির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এই সংগঠনগুলো নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী মানবিক কর্মকান্ডের বাস্তবায়ন শুরু করে দেয়। এই কাজে সংগঠনের কর্মীরা থাকেন সবার আগে। তারা স্থানীয় সমাজের অংশ, তাই স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও সরকার ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। দুর্যোগে আক্রন্ত কমিউনিটিতে তাদের পরিচিতি থাকায় সহজেই তাদের আস্থাভাজন হন এবং তাদের ভেতরে ঢুকে যেতে পারেন ও সহায়তা প্রদানের কাজে দ্রুত নিযুক্ত হতে পারেন। বিশেষত: নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত মানবিক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই স্থানীয় কর্মীরা খুবই উপযুক্ত। তাদের দ্রুত নিযুক্ত হওয়া ও সহায়তা প্রদান কাজ অনেক ক্ষেত্রেই অনেকের জীবন বাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু দেখা যায়, স্থানীয় সংগঠনের এই কর্মীরা বরাবরই থাকেন অবহেলিত ও উপেক্ষিত। এমনকি দায়িত্ব পালনকালীন মৃত্যু বরণ করলেও তাদের প্রতি তেমন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা প্রকল্পগুলোতে থাকেনা।

স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ কেন জরুরী?

মানবিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত স্থানীয় সংগঠনগুলো কমিউনিটিরই অংশ। যাই ঘটুক না কেন, জরুরী বা সংকটকালীন দ্রুততম সময়ে এই সংগঠনগুলো দুর্যোগে আক্রন্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই কাজগুলোকে সঠিক সময়ে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করার জন্য স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ খুবই জরুরী। কভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে আমরা দেখেছি যে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কর্মীদেরকে মাঠ থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। তারা ঘরে বসে “ওয়ার্ক ফর্ম হোম” করেছেন। কিন্তু স্থানীয় সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে স্থানীয় কর্মীরা সাড়াদান কাজে ঝাপিয়ে পড়েছেন। কখনই তারা কমিউনিটিকে ত্যাগ করেননি। আর স্থানীয় সংগঠনগুলোর অপারেশনাল খরচ নিতান্তই কম। এর ফলে উদ্বৃত্ব অর্থ দিয়ে তারা আরো অধিক সংখ্যক দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষকে সহায়তা প্রদান করতে পারেন। তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।

আমরা কি তাহলে স্থানীয় নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করছি?

সারা বিশ্বজুড়ে একটা স্বীকৃতি মিলেছে যে, স্থানীয় সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ও স্থানীয়করণই (Localization) হলো মানবিক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৬ সালে ইস্তাম্বুলে “ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিটারিয়ান সামিট” হয়। সেখানে দাতা সংস্থা ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ মানবিক কর্মকান্ডের যথাযথ সাড়া প্রদানের জন্য স্থানীয়করণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে “গ্রান্ড বার্গোইন” চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যেখানে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও স্থানীয় সংগঠনগুলোকে সরাসরি অথবা যতটুকু সম্ভব সরাসরি দাতাদের ২৫% তহবিল সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে এসেও আমরা স্থানীয় সংগঠণগুলো প্রতি এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তেমন উল্লেখযোগ কোন অগ্রগতি দেখতে পাইনা। গবেষণা সংস্থা “আলনাপ” এর ২০২২ সালে প্রকাশিত “দ্যা এস্টেট অব হিউম্যানিটারিয়ান সিস্টেম ” প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাপি মোট তহবিলের (২০১৮-২০২১) ৪৭% প্রদান করা হয়েছে মাত্র জাতিসংঘের ৩টি সংস্থাকে। আর স্থানীয় সংগঠনগুলোকে সরাসরি ২৫% তহবিল প্রদান করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা না বেড়ে বরং কমেছে । যেমন, ২০২০ সালে এই হার ছিল ৪% যা ২০২১ সালে এসে হয়েছে ২%। ২০২২ সালেও এর পরিবর্তন ঘটেনি। এটি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রদানকৃত প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয়।

তাই বিশ্ব মানবিক দিবসে আমাদের সুপারিশ:

১. মানবিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত স্থানীয় কর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় সকলকে কাজ করতে হবে। ভিন্ন মত-পার্থর্ক্য বা বিশ্বাসের জেরে তাদেরকে টার্গেটে পরিণত করা যাবে না।
২. স্থানীয় সংগঠনগুলোর সাথে পার্টনারশীপ এবং প্রকল্প তৈরির সময় দাতাদেরকে সচেতন থাকতে হবে যেন স্থানীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় প্রকল্পের কর্মীরা ন্যায্য বেতন, সুযোগ-সুবিধা, লাইফ ইনসুরেন্স ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত না হয়।
৩. গ্রান্ড বার্গেইন-এ প্রতিশ্রুত দাতাদের ২৫% তহবিল স্থানীয় সংগঠনগুলোকে প্রদানের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
৪. মানবিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত স্থানীয় কর্মীদের যথাযথ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. স্থানীয় পর্যায়ে দ্রুত সাড়াদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় সংগঠন ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। স্থানীয় সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সেক্ষেত্রে পার্টনারশীপ তৈরির সময় দাতা সংস্থা কর্তৃক কখন ও কিভাবে এই বিষয়গুলো করা হবে তার উল্লেখ থাকতে হবে।

ডাউনলোড বাংলা লিফলেট

সচিবালয়
কোস্ট ফাউন্ডেশন

বাড়ি: ১৩, সড়ক: ২, শ্যামলী, ঢাকা-১২০৭।
ফোন: ০২-৫৮১৫০০৮২, ৫৮১৫২৮২১।
ই-মেইল: info@coastbd.net,
ওয়েব: www.coastbd.net

Social Sharing

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here